নটবর বেশ
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভক্তের ইচ্ছাপূরণের জন্য বিভিন্ন সময়ে নানা অপ্রাকৃত লীলার রচনা করেন। শ্রীধাম বৃন্দাবনে ব্রজগোপীদের সাথে ভগবান সবচেয়ে মধুর লীলা আস্বাদন করেন। একবার লীলাপুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ ছল করে ব্রজগোপীদের সূর্যপূজার সামগ্রী হরণের জন্য ছদ্ধবেশ ধারণ করেছিলেন। তিনি ব্রজগোপীদের থেকে নন্দমহারাজের জন্য কর দাবী করছিলেন। কিন্তু ব্রজগোপীদের কাছে কৃষ্ণের ছদ্ধবেশ ধরা পরে যায়। ছল করার শাস্তি স্বরূপ গোপীকারা কৃষ্ণকে গোপীবেশে সাজিয়ে দেন এবং নৃত্য করতে বলেন। আর ভক্তের প্রাণনাথ লীলাধর কৃষ্ণ সেই গোপীবেশে নৃত্যকরেই গোপীদের আনন্দ বর্ধন করেছিলেন। নটবর কৃষ্ণের এই অনবদ্য নৃত্যরূপ ভক্ত হৃদয়ে আনন্দের সঞ্চার করে ।
শ্রীকৃষ্ণের জন্মবেশ
পরমেশ্বর ভগবান তার ভক্তদের সাথে মুখ্য ৫টি রসে যুক্ত থাকে। তার মধ্যে একটি রস হলো বাৎসল্য। এই রসে ভগবান তার ভক্তদের সন্তান রূপে আনন্দ প্রদান করেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দুজন প্রিয় ভক্ত নন্দমহারাজ ও যশোদা মাতার বাৎসল্য প্রেমে আকৃষ্ট হয়ে শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের গৃহে আর্বিভূত হয়েছিলেন এবং সমস্ত বৃন্দাবনবাসীদের বিচিত্র ও অপ্রাকৃত লীলা বিলাসের মাধ্যমে আনন্দ প্রদান করেছিলেন। ভগবান যখন বৃন্দাবনে আবির্ভূত হন তখন তাঁকে দর্শন করতে বিভিন্ন গ্রহলোক থেকে দেব- দেবতারা এমনকি ব্রহ্মা, শিব এবং নারদ মুনিগণও এসেছিলেন। বৃন্দাবনের সমস্ত গোপীরা তাঁর দিব্যরূপে আকৃষ্ট হয়ে বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে অভিষেক করতে আসেন, যেন নন্দ মহারাজের এই দিব্য পুত্রের সেবা করাই তাঁদের একমাত্র কাজ।
রাজাধিরাজ বেশ
ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীকৃষ্ণ ব্রজবাসীদের প্রাণধন। শ্রীকৃষ্ণকে ঘিরেই তাঁদের সমস্ত কার্যকলাপ। কিন্তু ব্রজবাসীদের বিরহের সাগরে নিমজ্জিত করে বৃন্দাবন ছেড়ে কৃষ্ণ মথুরায় চলে যান। মথুরা থেকে কৃষ্ণ বলরাম দ্বারকাধীশ হয়ে রাজ্যভার সামলাচ্ছেন। এদিকে কৃষ্ণ অদর্শনে ব্রজগোপীদের প্রাণ নির্গত হওয়ার অবস্থা। একবার সূর্য গ্রহণের পুণ্যক্ষণে দ্বারকা থেকে সমস্ত মহিষীদের নিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রে আসেন স্নান করবার জন্য। একথা জানতে পেরে সমস্ত গোপীরা কুরুক্ষেত্রে আসেন। তাঁরা রাজবেশে রথারূঢ় কৃষ্ণকে দেখে খুবই মর্মাহত হন। শ্রীকৃষ্ণকে পুনরায় বৃন্দাবনে নিয়ে যাওয়ার জন্য রথ আকর্ষণ করতে থাকেন। রাজবেশে শ্রীকৃষ্ণের ব্রজবাসীদের সাথে মিলনের এই দৃশ্য পটই রাজাধিরাজবেশের দৃশ্যপট।
বনবিহারী বেশ
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অপ্রাকৃত লীলার মাধ্যমে ব্রজবাসীদের সর্বদা আনন্দে মগ্ন রাখতেন এবং তাঁর প্রিয় ভক্তদের কাছে থেকে প্রীতিপূর্ণ উপহার গ্রহণ করতেন। একদিন কৃষ্ণ তার সখাদের সাথে বনে বিহার করতে গেলে তার প্রচণ্ড ক্ষুধা পায়। ফলে বনের অদূরে যজ্ঞ রত যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণগণের কাছে কিছু অন্ন ভিক্ষা প্রার্থনা করলে তাঁরা তাদের প্রার্থনা গ্রাহ্য করে না। কিন্তু যখন সখারা ব্রাহ্মণ পত্মীদের কাছে নিবেদন করে আমাদের প্রাণসখা কৃষ্ণের অনেক ক্ষুধা পেয়েছে কিছু খাবার দেওয়ার জন্য। তখন ব্রাহ্মণ পত্মীরা নিজেরাই তাদের স্বামীর আদেশ প্রত্যাখ্যান করে কৃষ্ণের সেবা করার জন্য কৃষ্ণের কাছে গমন করে। ভগবানের প্রতি ভক্তের প্রেম এমনই হয় যে, সমস্ত বাধা অতিক্রম করেও তার কাছে পৌঁছে যায় এবং বনবিহারী বেশে ভগবানের দর্শন লাভ করে।
বৎসহরণ বেশ
ভগবান ভগবদ্গীতায় বলেছেন, আমার জন্ম এবং কর্ম দিব্য, অর্থাৎ তাঁর জন্ম এবং কর্ম সাধারণ জীব বুঝতে পারবে না। এমনকি ব্রহ্মা পর্যন্ত ভগবানকে বুঝতে পারেননি। তিনিও মোহিত হয়েছেন। তিনি ভগবানকে পরীক্ষা করার জন্য গোবৎস এবং গোপবালকদের হরণ করেছিলেন। তাই ভগবান ব্রহ্মার এই কার্যাবলী বুঝতে পেরে নিজের থেকে সেই একই রকম গোপবালক ও গোবৎস সৃষ্টি করে লীলাবিলাস করতে থাকেন।
গোমতিকৃষ্ণ বেশ
ভক্তরা সর্বদা ভগবানের সেবা করার জন্য ব্যাকুল থাকেন । ভগবানও ভক্তের সেবার জন্য উৎকণ্ঠিত থাকে। একদিন নন্দ মহারাজ তাঁর পাদুকা আনার জন্য কৃষ্ণকে নির্দেশ প্রদান করলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ডের অধিপতি হওয়া সত্ত্বেও নন্দমহারাজের পাদুকা মস্তকে ধারণ করে আনায়ন করলেন। ভক্তির পাঁচটি মূখ্য রস রয়েছে- শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য, মধুর। এই লীলাটি বাৎসল্য রসের অন্তর্গত।
খট-দোলি বেশ
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে তাঁর হ্লাদিনী শক্তি শ্রীমতি রাধারাণীর সাথে অপ্রাকৃত মাধুর্যলীলা প্রকাশ করেন। মাধুর্য ভাবময়ী গোপীকারা রাধাকৃষ্ণকে নিয়ে কখনও ঝুলনলীলার অবতারণা করেন। একবার বৃন্দাবনের কুসুম সরোবরের তীরে রাধাকৃষ্ণের ঝুলন লীলা রচনা করেছিলেন । শ্রীমতির শ্রীঅঙ্গের পদ্মগন্ধের সৌরভে কুঞ্জের ভ্রমরেরা আসতে থাকে। ভ্রমরদের দেখে শ্রীমতি তাঁর হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেন। এক পর্যায়ে সখীরা ভ্রমরকে তাড়িয়ে দেন আর বলতে থাকে, হে রাধে, মধুসুদন চলে গেছে আর আসবে না। একথা শুনে শ্রীমতি মধুসুদনের (কৃষ্ণের) বিরহ অনুভব করতে থাকেন এবং ক্রন্দন করতে থাকেন। যদিও শ্রীকৃষ্ণ তার পাশেই বসেছিলেন। শ্রীমতির কান্না দেখে শ্রীকৃষ্ণও কান্না শুরু করেন। সেই সাথে গোপীকারাও কান্না করতে থাকেন। তাদের অশ্রুতে সেখানে এক কুণ্ডের সৃষ্টি হয়। প্রেমাশ্রু থেকে উৎপন্ন হয় বলে এই কুণ্ডের নাম হয় প্রেমসরোবর। আজকের ‘খট-দোলি’ বেশে অর্থাৎ ঝুলনলীলার মাঝে আমরা প্রেমসরোবরের সেই অপ্রাকৃত লীলারূপ দর্শন করছি।
চক্রনারায়ণ বেশ
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অনাদির আদি। তাঁর থেকেই প্রকাশিত হয় অনন্ত সৃষ্টি। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের থেকেই প্রকাশিত হয় সৃষ্টির পালন কর্তা শ্রীবিষ্ণু। গর্ভদোকশায়ী বিষ্ণু হলেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বিতীয় পুরুষাবতার। ক্ষীরদোকশায়ী বিষ্ণুর পত্নী শ্রীলক্ষ্মী দেবী হলেন শ্রীমতি রাধারাণীর অংশ প্রকাশ। শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী শ্রীবিষ্ণুর নাভিকমল থেকে প্রকাশিত হলো সৃষ্টির প্রথম জীব তথা সৃজনকর্তা ব্রহ্মা। ক্ষীরদসাগরে অনন্ত শয্যায় শায়িত শ্রীবিষ্ণুর পাদসেবায় রত শ্রীলক্ষ্মীদেবী। শিব, ব্রহ্মা, নারদ, গরুড় সকলে তাঁর প্রার্থনায় রত। উজ্জ্বল সুদর্শন চক্রধারী সেই বিষ্ণুরূপই চক্রনারায়ণ বেশ ।
নৌকেলি বেশ
পরমেশ্বর ভগবান হলেন এক ও অদ্বিতীয়। সৎ, চিৎ ও আনন্দময় বিগ্রহ। তিনি আত্মারাম হলেও তাঁর ভক্তদের আনন্দ দান করার জন্য বিভিন্ন লীলা রচনা করেন। তিনি সাধারণ মানুষের মতো জন্মগ্রহণ করেন এবং তদ্রপ আচরণও করেন, যেমনটি করেছিলেন বৃন্দাবনের গোপীদের সাথে। বৃন্দাবনের গোপীরা একদিন দধি, দুগ্ধ বিক্রি করার জন্য হাটে যাবেন কিন্তু যমুনা পার হবেন কি করে? কোনো মাঝি নেই। ঘাটে কিছু দূরে দেখতে পেলেন একজন মাঝি নৌকা নিয়ে বসে আছে। তখন তাঁরা ঐ মাঝির কাছে গেলেন, যমুনা পার হওয়ার জন্য। মাঝি রাজি হলো, কিন্তু নৌকায় তোলার পর পাড় হওয়ার কড়ি নিয়ে শুরু হলো দর কষাকষি। অবশেষে গোপীকারা ষোল আনা কড়ি দিতে রাজি হলো। কিছু ক্ষণের মধ্যে যমুনায় তুমুল ঝড় শুরু হলো। মাঝিরূপে কৃষ্ণের সেই বেশই হচ্ছে নৌকেলি বেশ।
নটবর বেশ
আমরা প্রায়ই শ্রীকৃষ্ণ এবং রাধারাণীকে নিয়ে বিভিন্ন অপবাদ দেই যে তাঁদের তো সামাজিকভাবে বিয়েই হয়নি। শ্রীমতি রাধারাণীর লীলামহিমা গ্রন্থে ভাণ্ডির বনে অনুষ্ঠিত শ্রীমতি রাধারাণী ও কৃষ্ণের বিবাহলীলা বর্ণনা করা হয়েছে। একদিন নন্দ মহারাজ গোপালকে নিয়ে বনে যাচ্ছিলেন হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয় এবং তাঁর অদূরেই শ্রীমতি রাধারাণীকে আসতে দেখে নন্দ মহারাজ শ্রীকৃষ্ণকে শ্রীমতি রাধারাণীর হস্তে অর্পণ করে চলে যান। শ্রীমতি রাধারাণী কৃষ্ণকে নিয়ে ভাণ্ডির বনে এক মনোজ্ঞ পরিবেশে উপস্থিত হলে শ্রীকৃষ্ণ নবযৌবন সম্পন্ন এক দিব্য রূপ পরিগ্রহ করেন এবং মনে মনে ব্রহ্মাকে স্মরণ করেন। ব্রহ্মা তৎক্ষণাৎ তাঁর সামনে আবির্ভূত হন এবং তাঁদের বিভিন্ন স্তব-স্তুতি করেন। শ্রীকৃষ্ণের আজ্ঞানুসারে ব্রহ্মা বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করেন। বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে তাঁদের যজ্ঞে আহুতি এবং যজ্ঞবেদী পরিক্রমার মাধ্যমে বিবাহ কর্ম সম্পন্ন করেন। অবশেষে কৃষ্ণ শ্রীমতির গলে মালাপ্রদান করেন এবং শ্রীমতিও শ্রীকৃষ্ণের গলে মালা পড়ালেন। ব্রহ্মাও তাদের যুগলরূপ দর্শন করে পূর্ণ তৃপ্তি সহকারে তাঁদের গুণগান করতে থাকেন। ব্রহ্মা শিব অন্যান্য দেবতারা, গর্ন্ধব ও কিন্নররা এই দৃশ্য দেখে নৃত্য এবং পুষ্প বৃষ্টি প্রদান করেন।
শ্রীরাসমণ্ডল বেশ
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরম মাহাত্ম্যপূর্ণ আর মাধুর্যমণ্ডিত লীলা হল রাসলীলা। রাসনৃত্যের এক পর্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ রাসমণ্ডল থেকে অন্তর্দ্ধান হন। সমস্ত গোপীকারা শ্রীমতি রাধারাণীকে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে অন্বেষণ করতে থাকেন। লীলাপুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের পরীক্ষা করার জন্য চতুর্ভূজ নারায়ণ রূপে কুণ্ডের পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। গোপীকারা নারায়ণকে দেখে প্রণাম করে শ্রীকৃষ্ণের সন্ধান জিজ্ঞাসা করেন। তাঁরা নারায়ণ রূপে আকৃষ্ট হননি। তাদের মনে প্রাণে সর্বত্রই কেবল লীলা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের বিচরণ। রাসমণ্ডলের এই রূপই শ্রীরাসমণ্ডল বেশ।
কন্দর্পরথ বেশ
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভক্ত মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লীলার অবতারণা করেছিলেন। উনি দ্বারকাধীশ থাকা অবস্থায় বিধর্বা নগরের রাজকন্যা শ্রীমতি রুক্ষ্মিণী দেবী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রূপের মহিমা শুনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পতি রূপে বরণ করেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণর রূপ হচ্ছে কোটি কন্দর্পের চেয়েও কোমনীয়। “কন্দর্পকোটিকমনীয়বিশেষশোভং” এ জন্য ভগবানের রূপ যা কিনা কোটি কন্দর্পকে অর্থাৎ কামদেব কেউ হার মানায় তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে আকর্ষণ করে। কৃষ্ণ রুক্ষ্মিণীদেবীর আহবানে সাড়া দিয়ে গৌরী পূজার ছলে যখন মন্দিরে অবস্থান করছিলেন তখন সে অবস্থায় রথে করে রুক্ষ্মিণীদেবীকে হরণ করে নিয়ে যান। কৃষ্ণ রথে আরোহণ করেছিলেন। আজকে আমরা কোটি কন্দর্পের চেয়েও আকর্ষণীয়, মোহনীয় সেই কৃষ্ণের রুক্ষ্মিণী হরণ বেশ কন্দর্পরথবেশের মাধ্যমে দর্শন করছি।
অঘাসুরবধ বেশ
একবার কৃষ্ণ-বলরাম সখাবৃন্দসহ একটি বনে প্রবেশ করলে কৃষ্ণকে বধ করতে কংস অঘাসুরকে প্রেরণ করেন। অঘাসুর তখন একটি গুহার রূপ ধারণ করে। সখারা গাভীদের ছেড়ে দিয়ে খেলতে খেলতে নতুন একটি গুহা দেখে সেখানে প্রবেশ করতে থাকে। কিন্তু কৃষ্ণ জানেন সেটা আসলে কি? কৃষ্ণ গুহার ভিতরে প্রবেশ করা পর্যন্ত অঘাসুর অপেক্ষা করছিল। কৃষ্ণ প্রবেশ করলে গুহার মুখ আটকে দেয় অঘাসুর। তখন সখারা বাতাসের অভাবে অজ্ঞান হয়ে যান। কৃষ্ণ পেটের ভেতরে থেকে কিল ঘুষি মেরে অঘাসুরের প্রাণ বায়ু হরণ করে সখাদের সেখান থেকে মুক্ত করেন। কৃষ্ণের সেই বেশের নামই অঘাসুরবধ বেশ।
রঘুনাথ বেশ
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অসংখ্য অবতার রয়েছে। তার মধ্যে একটি অবতার হলো রাম অবতার। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র পৃথিবীতে এসে স্থাপন করেছেন একজন আদর্শ রাজার জীবন কেমন হওয়া উচিত। তিনি পিতৃসত্য পালনের জন্য রাজ্য পরিত্যাগ করে ভাই লক্ষ্মণ ও স্ত্রী সীতাদেবীসহ বনে গমন করেন। তাঁর অপর দুই ভাই ভরত ও শত্রুঘ্ন তখন মামা বাড়িতে ছিলেন। তাঁরা এসে রামের বনবাসের কথা শুনতে পেরে খুবই মর্মাহত হন এবং রামকে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রতিজ্ঞা করেন। তখন মাতা ও ভ্রাতা শত্রুঘ্নসহ অন্যান্য প্রজাদের নিয়ে ভরত অযোধ্যায় ফিরে আসার জন্য রামচন্দ্রের কাছে প্রার্থনা করলেন। রাম কিছুতেই রাজ্যে ফিরে যেতে সম্মত না হলে অবশেষে ভরত রামের কাছে পাদুকা প্রার্থনা করে, তখন রামচন্দ্র তাঁর পাদুকা দান করে ভরতকে তুষ্ট করেন। ভরত তখন প্রীতির সাথে সেই পাদুকা মস্তকে ধারণ করেন।
শ্রীচৈতন্য বেশ
একবার রাধারাণী কুঞ্জ সাজিয়ে কৃষ্ণের জন্য বসে আছেন কিন্তু কৃষ্ণ চন্দ্রাবলীর কুঞ্জে তাঁর সঙ্গে লীলাবিলাস করছিলেন। এ সংবাদ শোনার পরে শ্রীমতি রাধারাণী মান করে সখীদের নির্দেশ দেন তার কুঞ্জে যেন কৃষ্ণ প্রবেশ করতে না পারে। এ সংবাদ শোনার পরে কৃষ্ণ সন্ন্যাসী রূপ ধারণ করে রাধারাণীর কুঞ্জের দিকে যাচ্ছিলেন। তখন ললিতাদেবী সেই সন্ন্যাসীকে দেখে তাঁকে রাধারাণীর কক্ষে নিয়ে আসেন এবং সন্ন্যাসীকে বললেন আমাদের সখীর ভাগ্যে কী আছে দেখুন। তখন সন্ন্যাসী বললেন আমি কোন নারীর হাত স্পর্শ করি না, তবে কপাল দেখে বলে দিতে পারি তার ভাগ্যে কী আছে। ললিতা সখী তখন রাধারাণীর ঘোমটা তুলে দেন আর রাধারাণী দেখতে পান কৃষ্ণ সন্ন্যাসী বেশে দাঁড়িয়ে আছেন।
গিরিগোবর্ধন বেশ
ব্রজবাসীরা বৃষ্টির জন্য ইন্দ্রের পূজা করত। এটা ছিল ওদের পরম্পরাগত পূজাবিধি কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নন্দমহারাজকে যখন জিজ্ঞাসা করে তারা কেন ইন্দ্রের পূজা করছে? তখন নন্দমহারাজ বললেন, ইন্দ্রের পূজা না করলে বৃষ্টি হবে না। ফলে গিরি-গোবর্ধন পর্বতে ঘাস হবে না এবং ঘাস না হলে গাভীরা কি খাবে? আমরা গাভীদের খাদ্য না দিলে দুধ পাবো না ফলে আমাদের জীবিকা নির্বাহ বন্ধ হবে। তখন শ্রীকৃষ্ণ বলল, বৃষ্টি তো ভগবান প্রদান করে। সেজন্য ইন্দ্রের পূজার দরকার নেই; পূজা করতে হলে গোবর্ধনের পূজা কর। গোবর্ধনের পূজার ফলেই আমাদের বৃন্দাবন সমৃদ্ধ হবে। তখন শ্রীকৃষ্ণের কথা মতো সবাই মহাসমারোহে ইন্দ্রের পূজার পরিবর্তে গিরি-গোবর্ধনের পূজা আরম্ভ করেন।
গিরিধারী বেশ
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথায় নন্দ মহারাজ যখন সমস্ত ব্রজবাসীদের নিয়ে ইন্দ্রের পূজার পরিবর্তে গোবর্ধনের পূজা আরম্ভ করলেন। তখন ইন্দ্র মিথ্যা অহঙ্কারের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে ব্রজবাসীদের উপর ক্রোধিত হলেন। তিনি প্রবল বেগে ঝড় আরম্ভ করলেন তখন সমস্ত ব্রজবাসীরা নন্দমহারাজের কাছে সাহায্য চাইলে কৃষ্ণ তাদের নিয়ে গোবর্ধনের পাদদেশে উপস্থিত হল এবং বালক কৃষ্ণ গোবর্ধনকে একটি ছত্রের মত বাম হাতের কনিষ্ট আঙ্গুলের নখাগ্রে ধারণ করল। সমস্ত ব্রজবাসীরা গোবর্ধনের নিচে আশ্রয় গ্রহণ করল এবং কৃষ্ণের বংশীধ্বনি শুনতে শুনতে আনন্দ করতে লাগল।
বস্ত্রহরণ বেশ
গোপীকারা কার্তিক মাসে একমাস ধরে যমুনার জলে স্নান করে বালু দিয়ে কাত্যায়নী মূর্তি বানিয়ে তাঁর পূজা করত এবং মায়ের কাছে কৃষ্ণকে তাঁদের স্বামীরূপে পাওয়ার বর প্রার্থনা করত। ব্রতের শেষের দিন কৃষ্ণ তাঁদের নিজ নিজ বস্ত্র রেখে স্নান করতে নামলেন। এ সুযোগে কৃষ্ণ গোপীদের বস্ত্র নিয়ে গাছের উপরে চড়ে বাঁশি বাজাতে শুরু করেন। গোপীকারা কৃষ্ণের কাছে তাদের বস্ত্র ভিক্ষা করেন। কিন্তু কৃষ্ণ তীরে এসে বস্ত্র নিয়ে যেতে বলেন। এ কথা শুনে গোপীকারা লজ্জায় লাল হয়ে যান। অবশেষে কৃষ্ণ তাঁদেরকে বস্ত্র ফিরিয়ে দিয়ে আশ্বস্ত করেন যে, রাস রজনীতে তাদের মনোভিলাষ পূরণ করবেন।
চিন্তামণি কৃষ্ণ বেশ
একবার এক ফলওয়ালী ঝুড়ি ভর্তি ফল নিয়ে গোকুলের পথে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সে দিন কোনো ফলই বিক্রি হচ্ছে না। অবশেষে নন্দমহারাজের বাড়ির সামনে উপস্থিত হলে তিনি নন্দ মহারাজের পুত্রকে দেখে তাঁর গোপাল রূপের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। গোপাল কৃষ্ণ ফলওয়ালীকে দেখে ঘর থেকে তার কাছে দৌড়ে আসলো এবং বললো আমাকে কিছু ফল দেবে? ফলওয়ালী তার রূপে এতই আকৃষ্ট হয়েছিল যে, গোপাল কৃষ্ণের মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে নয়ন থেকে প্রেমে অশ্রু বর্ষণ করতে লাগল এবং তার ঝুড়ি থেকে ফল দিতে লাগল। গোপাল কৃষ্ণ ফল ঘরে রেখে তার ছোট হাতের মুঠিতে কিছু ধন-রত্ন এনে তা ফলওয়ালীকে দিল। ফলওয়ালী সেই সামান্য ধন-রত্ন তার ঝুড়িতে রাখতেই ঝুড়ি মণি মুক্তায় ভরে গেলো। সত্যিই শ্রীকৃষ্ণের লীলা অদ্ভুত অচিন্ত্য।
গজ উদ্ধারণ বেশ
একবার গজেন্দ্র তার পরিবার পরিজনদেরকে নিয়ে আনন্দ বিলাসের জন্য এক সরোবরের নিকটে আসে। সরোবরে নেমে সকলে মিলে জলকেলি করছে। হঠাৎ একটি কুমির গজেন্দ্রের পা কামড়ে ধরলে গজেন্দ্র তার সাথে ভয়ংকর যুদ্ধ করেন। তার আত্মীয়-স্বজনেরা তাকে ছেড়ে তীরে দাড়িয়ে কান্না করছেন। গজরাজ প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকলে ধীরে ধীরে শক্তি নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগল। তখন সে নিশ্চিত মৃত্যু জেনে সরোবরে ফুটে থাকা একটি সুন্দর পদ্ম শুর দিয়ে তুলে ভগবানের চরণ কমলের উদ্দেশ্যে নিবেদন করলে ভগবান তার সামনে হাজির হন। তখন তিনি ভগবানের উদ্দেশ্যে স্তব-স্তুতি করেন। তখন প্রথমে তার চক্র দিয়ে কুমিরকে উদ্ধার করেন তার মস্তক ছেদন করেন। তারপরে গজেন্দ্রকে উদ্ধার করেন। আজ আপনারা সে লীলাই দর্শন করছেন।